সুতরাং বলা যায় সুন্নাত হলো এমন বিধানের নাম যা পালন করা আবশ্যক নয়। করলে সওয়াব হবে। কিন্তু না করলে গোনাহ হবে না।
সুন্নাতের প্রতি সালাফের ভালোবাসা ও অনুরাগের চিত্র
১/ মুসলিম শরীফে আমর বিন আউস রা. থেকে নুমান বিন সালিম রা.এর বর্ণনা। তিনি বলেন, আনবাসা ইবনে আবু সুফিয়ান আমাকে বলেছেন, উম্মে হাবীবাকে আমি বলতে শুনেছি, প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি দিনে ও রাতে বারো রাকাআত নামাজ আদায় করবে, বিনিময়ে তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মিত হবে।’ (মুসলিম: ১৭২৭)। উম্মে হাবীবা রা. বলেন, নবীজীর মুখে এই হাদীস শোনার পর থেকে কোনোদিন আমি সেই নামাজ ছাড়িনি। আনবাসা বলেন, উম্মে হাবীবা রা. থেকে এই হাদীস শোনার পর থেকে কোনোদিন আমি এই নামাজ ছাড়িনি।
আমর বিন আউস বলেন: আনবাসা থেকে শোনার পরে আমিও কোনোদিন ছাড়িনি।
নুমান বিন সালেম বলেন, আমর বিন আউস থেকে শোনার পর থেকে আমিও কোনোদিন এই নামাজগুলো ছাড়িনি।
২/ আলী রা. এর হাদীস। যাতা ঘুরাতে ঘুরাতে এক পর্যায়ে ফাতেমা রা. এর হাত যখম হয়ে যায়। ঠিক সেই সময় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে কিছু যুদ্ধবন্দী আসে। তখন তিনি নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে ( ভৃত্যের জন্য) ছুটে যান। কিন্তু নবীজীকে না পেয়ে আয়েশা রা. কে বিষয়টি জানিয়ে চলে আসেন। নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে এলে আয়েশা রা. তাঁকে বিষয়টি জানান। আলী রা. বলেন, রাতের বেলা আমরা তখন শুয়ে পড়েছিলাম। এমন সময় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের বাড়িতে এলেন। আমরা উঠতে গেলে তিনি বললেন, ‘বসো বসো!’ এরপর তিনি আমাদের দু’জনের মাঝে বসলেন। আমার বুকের ওপর তাঁর পায়ের শীতলতা অনুভব করছিলাম। তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তুর চেয়ে উত্তম কিছু দিবো না? যখন তোমরা বিছানায় যাবে, তখন ৩৪ বার আল্লাহু আকবার বলবে, ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ বলবে। আর ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ বলবে। এটা ভৃত্যের চেয়ে তোমার জন্য উত্তম। (বুখারী: ৩৭০৫, মুসলিম: ২৭২৭)
অপর একটি বর্ণনায় আলী রা. বলেন, নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখ থেকে শোনার পর থেকে উক্ত আমলটি শোনার পরে আমি কোনোদিন ছাড়িনি। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো: ‘সিফফীন যুদ্ধের ভয়ংকর রাতেও নয়’? তিনি বললেন, ‘সিফফীনের রাতেও নয়’! (বুখারী: ৫৩৬২, মুসলিম: ২৭২৭)
উল্লেখ্য, সিফফীন যুদ্ধের রাত যে কি পরিমাণ ভয়ংকর ছিল সচেতন ব্যক্তিমাত্রই সেটা জানেন। উপরন্তু আলী রা. ছিলেন একটি বাহিনীর সিপাহসালার। এতদ্বসত্তেও তিনি এই সুন্নাতটি ছেড়ে দেননি।
৩/ ইবনে উমর রা. জানাজার নামাজ পড়েই ঘরে ফিরে আসতেন। পূণাঙ্গ সুন্নাত হিসেবে লাশের সঙ্গে যেতেন না। জানাজার পর থেকে দাফন পর্যন্ত লাশের সঙ্গে যাওয়া কত বড় সওয়াবের কাজ সেটা জানতেন না। পরবর্তীতে যখন এ ব্যাপারে আবু হুরাইরা রা. এর হাদীস শুনতে পেলেন, তখন তিনি চরম মর্মাহত হলেন। বলুন তো কী করলেন?
তাঁর হাতে কিছু পাথরকুচি ছিল। সেগুলো মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে বললেন, অসংখ্য ‘ক্বীরাত’ (বিশাল পরিমাণ সওয়াব) থেকে বঞ্চিত হলাম। (বুখারী: ১৩২৪, মুসলিম ৯৪৫)
ইমাম নববী র. বলেন, উপর্যুক্ত হাদীস দ্বারাই বোঝা যায় নেক আমলের প্রতি সাহাবায়ে কিরামের কতটা অনুরাগ ছিল। অজ্ঞাতসারেও কোনো আমল ছুটে গেলে সেটার প্রতি তাদের কত বেশি আফসোস ছিল! । দেখুন: আল-মিনহাজ: ৭/১৫) )
সুন্নাত অনুসরণের সুফল
প্রিয় ভাই আমার! নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাত অনুসরণের ভেতরে রয়েছে অসংখ্য উপকারিতা। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১/ ভালোবাসা লাভ করা। কারণ নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে গিয়ে বান্দা আল্লাহর ভালোবাসা লাভ করে।
ইবনুল কাইয়্যিম র. বলেন, ‘আল্লাহর ভালোবাসা তখনই অর্জিত হবে, যখন কেউ প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে তাঁর প্রিয় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অনুসরণ করবে। তাঁকে সত্যায়ন করবে। তাঁর নির্দেশ পালন করবে। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিবে। তাঁর আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দিবে। তাঁর নির্দেশের সামনে অন্যের নির্দেশকে জলাঞ্জলি দিবে। তাঁর ভালোবাসার সামনে অন্যের ভালোবাসাকে উৎসর্গ করবে। তাঁর আনুগত্যের সামনে জগতের সবার আনুগত্যকে তুচ্ছজ্ঞান করবে। এটা যদি কারও ভেতরে তৈরি না হয় তবে তাকে তার দীন ও ঈমান নিয়ে আবারও ভাবতে হবে। তাকে আলোর সন্ধান করতে হবে। কারণ সে অন্ধকারে আছে’। মাদারিজুস সালেকীন: ৩/৩৭
২/ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ। তখন আল্লাহ তাকে নেক আমলের তাওফীক দিবেন। ফলে তাঁর থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি বিরুদ্ধ কোনো কিছু প্রকাশ পাবে না। কারণ যখন আল্লাহর ভালোবাসা অর্জিত হবে, তখন সান্নিধ্যও লাভ হবে।
৩/ দুআ কবুল হওয়া। কারণ যে নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হবে সে তাঁর ভালোবাসা লাভ করবে। আর যে তাঁর ভালোবাসা লাভ করবে, তার দুআও তিনি কবুল করবেন।
নফল ইবাদতের উপর্যুক্ত তিন ফলাফলের দলীল হচ্ছে:
আবু হুরাইরা রা. এর হাদীস। তিনি বলেন, নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যে আমার কোনো অলীর (বন্ধু) বিরোধিতা করলো, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিলাম। ফরজ ইবাদতের চেয়ে অধিক প্রিয় আর কিছুর মাধ্যমে বান্দা আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে না। এরপর বান্দা যখন নফল ইবাদত করতে থাকে, তখন আমি তাকে ভালোবাসতে শুরু করি। যখন আমি তাকে ভালোবাসি, তখন আমি তার কান হয়ে যায় যার দ্বারা সে শোনে। আমি তার চোখ হয়ে যায় যার দ্বারা সে দেখতে পায়। আমি তার হাত হয়ে যায় যার দ্বারা সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যায় যার দ্বারা সে চলে। তখন সে আমার কাছে যা চায় আমি তাকে দান করি। আমার কাছে আশ্রয় চাইলে তাকে আশ্রয় দিই। মুমিন বান্দাকে মৃত্যু দেয়ার বিষয়টিই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি দ্বিধাকর। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তাকে (মৃত্যুদান করে) কষ্ট দেয়াকে অপছন্দ করি। (বুখারী: ৬৫০২)
৪/ ফরজের ক্ষেত্রে সৃষ্ট ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ। ফরজ ইবাদতের ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি থাকলে নফল দিয়ে সেটাকে পুরণ করা যায়।
দলীল:
আবু হুরাইরা রা. এর হাদীস। তিনি বলেন, আমি প্রিয় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছি: ‘কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার নামাজের হিসাব হবে। যদি এ হিসাব সঠিক হয়, তবে সে সফলকাম। আর যদি এ হিসাব সঠিক না হয়, তবে সে ব্যর্থ ও অসফল। তবে যদি তার ফরজের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি দেখা যায়, তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, তোমরা দেখো তার কোনো নফল ইবাদত আছে কি না? যদি থাকে তবে সেই নফল দিয়ে ফরজের ঘাটতি পূরণ করা হবে। এরপর একই পদ্ধতিতে সকল আমলের হিসাব সম্পন্ন হবে। (আহমদ: ৯৪৯৪, আবূ দাঊদ ৮৬৪, তিরমিযী ৪১৩)। (আলবানী- সহীহুল জামি’ ১/৪০৫)