|
প্রশ্ন: তাহাজ্জুদের সর্বোত্তম সময় কখন? উত্তর: বিতরের নামাজের সময় হচ্ছে ইশার নামাজের পর থেকে সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত। সুতরাং তাহাজ্জুদের সময়ও হচ্ছে ইশার পর থেকে ফজরের আগ পর্যন্ত। দলীল: আয়েশা রা. এর হাদীস। তিনি বলেন, ‘রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইশা ও ফজরের মাঝখানে এগারো রাকাআত নামাজ পড়তেন। দুই দুই রাকাআত পড়ে সালাম ফেরাতেন। শেষে এক রাকাআত পড়তেন’। (বুখারী ২০৩১, মুসলিম ৭৩৬) তবে তাহাজ্জুদ নামাজের সর্বোত্তম সময় হচ্ছে রাতের শেষ ভাগ। মধ্যরাতের পরে শেষ তৃতীয়াংশে। আরেকটু ব্যাখা দিয়ে বললে বলা যায়, রাতকে কয়েক ভাগে ভাগ করবে। প্রথমে দুই ভাগে ভাগ করবে। এরপর দ্বিতীয় ভাগের এক তৃতীয়াংশে নামাজ পড়বে। একেবারে শেষ প্রহরে ঘুমাবে। অন্য কথায়, পুরো রাতকে ছয় ভাগে ভাগ করবে। চতুর্থ ও পঞ্চম ভাগে নামাজ পড়বে। ষষ্ঠ ভাগের সময়টুকু ঘুমাবে। দলীল: আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. এর হাদীস। তিনি বলেন, নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় রোজা হচ্ছে দাঊদ আ. এর রোজা। আর সবচেয়ে প্রিয় নামাজ হচ্ছে দাঊদ আ. এর নামাজ। তিনি অর্ধরাত পর্যন্ত ঘুমাতেন। এরপর এক তৃতীয়াংশ ভাগ নামাজ পড়তেন। সর্বশেষ রাতের ষষ্ঠাংশ ঘুমাতেন। তিনি একদিন রোজা রাখতেন আর পরের দিন বিরতি দিতেন। (বুখারী ৩৪২০, মুসলিম ১১৫৯) কেউ তাহাজ্জুদ পড়তে চাইলে রাতের হিসাব কীভাবে করবে? সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়ের হিসেব করে পুরো রাতকে ছয় ভাগে ভাগ করবে। প্রথম তিন ভাগ হবে রাতের প্রথম অর্ধেক। তাহাজ্জুদ পড়বে এই সময়ের পরে। অন্য কথায়, রাতের চতুর্থ ও পঞ্চম ভাগে পড়বে। কেননা এই দুই সময়ই মূলত হচ্ছে রাতের এক তৃতীয়াংশ (ছয় ভাগের দুই ভাগ)। সর্বশেষ ভাগে ঘুমাবে। এ কারণেই আয়েশা রা. বলেছেন ,‘সাহরীর সময়ে প্রিয় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে সর্বদা নিদ্রিত দেখেছি’। (বুখারী ১১৩৩, মুসলিম ৭৪২) এভাবে হিসেব করেই রাতের সর্বোত্তম অংশে নামাজের ফজীলত অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ। পেছনে উল্লিখিত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. এর হাদীসও এটাই বোঝায়। সুতরাং সকল বক্তব্যের খোলাসা হলো: তাহাজ্জুদ নামাজের সর্বোত্তম সময় তিনটি ধাপে বিন্যস্ত: সর্বোচ্চ ধাপ: রাতের অর্ধভাগ ঘুমাবে। এরপর এক তৃতীয়াংশ নামাজ পড়বে। এরপর সর্বশেষ ষষ্ঠাংশ ঘুমাবে। এর দলীল হলো আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. এর হাদীস। দ্বিতীয় ধাপ: রাতের শেষ এক তৃতীয়াংশে নামাজ পড়বে। এর দলীল হচ্ছে: আবু হুরাইরা রা. এর হাদীস। প্রিয় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যখন প্রত্যেক রাতের সর্বশেষ এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকে, তখন আমাদের রব আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন। অতঃপর তিনি বলতে থাকেন, এমন কে আছে যে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দিবো। এমন কে আছে যে আমার কাছে চাইবে আমি তার চাওয়া পূরণ করবো। এমন কে আছে যে আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো’। (বুখারী ১১৪৫, মুসলিম ৭৫৮)। জাবের রা. থেকেও এতদ্বসংশ্লিষ্ট হাদীস রয়েছে। সামনের অধ্যায়ে সেটার আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ। যদি শেষ রাতে উঠতে না পারার আশংকা করে, তবে রাতের শুরু ভাগে কিংবা রাতের যে কোনো সময়ে সুযোগ মতো পড়ে নিবে। এটা হলো তৃতীয় ধাপের ফজীলত। তৃতীয় ধাপ: রাতের শুরু ভাগে কিংবা যখন সম্ভব হয় পড়ে নিবে। দলীল: জাবের রা. এর হাদীস। তিনি বলেন, প্রিয় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যদি কারও শেষ রাতে উঠতে না পারার আশংকা থাকে, তবে সে যেন রাতের শুরুভাগেই বিতরের নামাজ পড়ে নেয়। আর যদি কারও ওঠার প্রবল সম্ভাবনা থাকে, তবে সে যেন শেষ রাতে পড়ে। কেননা শেষ রাতের নামাজে ফিরিশতরা উপস্থিত থাকে। সেটাই সর্বোত্তম’। (মুসলিম ৭৫৫) |
পাশাপাশি বিভিন্ন সাহাবীর প্রতি প্রিয় নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসীয়তকেও এক্ষেত্রে দলীল হিসেবে পেশ করা যায় নাসাঈর সুনানে কুবরা (২৭১২), সহীহুল আলবানী (২১৬৬) তে আবু যরের প্রতি অসীয়ত, আহমদ (২৭৪৮১), আবু দাঊদ (১৪৩৩), সহীহু আবু দাঊদ আলবানীর (৫/১৭৭) তে আবু দারদার প্রতি অসীয়ত, মুসলিম (৭৩৭) এ আবু হুরাইরার প্রতি অসীয়ত। প্রত্যেকেই বলেছেন, ‘আমার প্রিয় বন্ধু (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে তিনটি অসীয়ত করেছেন। তন্মধ্যে একটি হলো ‘ঘুমের আগে বিতর পড়ে নিতে বলেছেন’।
|
আয়েশা রা. এর হাদীস দ্বারা বোঝা যায় এটাই সর্বোত্তম। তিনি বলেন, ‘রমজান কিংবা রমজানের বাইরে কোনো সময় প্রিয় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এগারো রাকাআতের বেশি (রাতে) নামাজ পড়তেন না’। (বুখারী ১১৪৭, মুসলিম ৭৩৮) কিন্তু মুসলিম শরীফে আয়েশা রা. এর হাদীসে এসেছে, নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তেরো রাকাআত নামাজও পড়েছেন। |
ক. মুসলিম শরীফে আয়েশা রা. এর সূত্রে বর্ণনা এসেছে, ‘নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তাহাজ্জুদ নামাজে দাঁড়াতেন, তখন শুরুতে বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা রাব্বা জিবরাঈল ওয়া মীকাঈল ওয়া ইসরাফীল, ফাতিরাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ। আলিমাল গাইবি ওয়াশ শাহাদাহ। আনতা তাহকুমু বাইনা ইবাদিকা ফীমা কানূ ফীহি ইয়াখতালিফুন। ইহদিনী লিমাখ তুলিফা ফীহি মিনাল হাক্কি বিইযনিক। ইন্নাকা তাহদী মান তাশাউ ইলা সিরাতিম মুসতাকীম’। (মুসলিম ৭৭০)
খ. বুখারী ও মুসলিমে ইবনে আব্বাস রা. এর সূত্রে হাদীস তিনি বলেন, ‘প্রিয় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তাহাজ্জুদ নামাজে দাঁড়াতেন, তখন বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা লাকাল হামদ। আনতা নূরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ। ওয়া লাকাল হামদু আনতা কাইয়্যিমুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ। ওয়ালাকাল হামদু আনতা রাব্বুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়া মান ফীহিন্না। আনতাল হাক্ক। ওয়া ওয়াদুকাল হাক্ক। ওয়া কাওলুকাল হাক্ক। ওয়া লিকাউকাল হাক্ক। ওয়াল জান্নাতু হাক্ক। ওয়ান নারু হাক্ক। ওয়ান নাবিয়্যূনা হাক্ক। ওয়াস সাআতু হাক্ক। আল্লাহুম্মা লাকা আসলামতু। ওয়া বিকা আমানতু। ওয়া আলাইকা তাওয়াককালতু। ওয়া ইলাইকা আনাবতু। ওয়া বিকা খাসামতু। ওয়া ইলাইকা হাকামতু। ফাগফিরলী মা কাদ্দামতু। ওয়া মা আখখারতু ওয়া মা আসরারতু ওয়া মা আ’লানতু। আনতা ইলাহী লা ইলাহা ইল্লা আনতা’। (বুখারী ৭৪৯৯, মুসলিম ৭৬৮)
|
ক. ধীরে ধীরে পড়বে। তাড়াহুড়া করে দ্রুত পড়বে না আবার অতিরিক্ত ধীরেও পড়বে না। খ. আয়াত আয়াত করে পড়বে। অন্য কথায়, প্রয়োজন ছাড়া দুই তিন আয়াত এক শ্বাসে মিলিয়ে পড়বে না। প্রত্যেক আয়াতের শেষে ওয়াকফ করবে। গ. যখন ‘তাসবীহ’ সংক্রান্ত কোনো আয়াত পড়বে তখন তাসবীহ পাঠ করবে। যখন আল্লাহর কাছে চাওয়া সংক্রান্ত কোনো আয়াত পাঠ করবে তখন চাইবে। যখন আশ্রয় প্রার্থনামূলক কোনো আয়াত পাঠ করবে তখন আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে। এগুলোর দলীল হচ্ছে: হুযাইফা রা. এর হাদীস। তিনি বলেন, ‘আমি এক রাতে প্রিয় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সঙ্গে নামাজে দাঁড়ালাম। তিনি সূরা বাক্বারা পড়তে শুরু করলেন। আমি ভাবলাম হয়তো একশ’ আয়াত পড়ে তিনি রুকূতে যাবেন। কিন্তু তিনি এক শ’র পরেও পড়তে লাগলেন। আমি মনে মনে বললাম সূরাটি শেষ করে তিনি রুকূতে যাবেন। কিন্তু তিনি বাক্বারা শেষ করেও রুকূতে গেলেন না। নিসা পড়তে শুরু করলেন। নিসা শেষ করে তিনি আলে ইমরান শুরু করলেন। সেটাও শেষ করলেন। তিনি খুব ধীরে ধীরে পড়ছিলেন। যখনই কোনো তাসবীহের আয়াত পড়ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাসবীহ পড়ে নিতেন। যখনই কেনো চাওয়া-পাওয়া সংক্রান্ত আয়াত আসছিলো তিনি আল্লাহর কাছে চাইতেন। যখনই কোনো আশ্রয়মূলক আয়াত আসছিলো তিনি আশ্রয় চাচ্ছিলেন। অতঃপর তিনি রুকূতে গেলেন। গিয়ে দুআ করতে লাগলেন ‘সুবহানা রাব্বী আল-আযীম’। রুকূতেও তিনি দাঁড়ানো পরিমাণ সময় বিলম্ব করলেন। এরপর তিনি ‘সামিআল্লাহু লিমান হামিদা’ বলে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। এই দণ্ডায়মানও ছিল রুকূর কাছাকাছি পরিমাণ দীর্ঘ। অতঃপর তিনি সিজদায় গিয়ে বলতে লাগলেন ‘সুবহানা রাব্বী আল-আ’লা’। তাঁর সিজদার পরিমাণও ছিল ক্বিয়াম পরিমাণ দীর্ঘ’! (মুসলিম ৭৭২) |
উম্মে সালামা রা. থেকে মুসনাদে আহমদেও একটি রেওয়ায়েত রয়েছে। যেখানে তাঁকে প্রিয় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ক্বিরাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, তিনি প্রত্যেকটি আয়াত আলাদা আলাদা করে পড়তেন। যেমন: বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। আররাহমানির রাহীম। মালিকি ইয়াও মিদ্দীন। (আহমদ ২৬৫৮৩, ইমাম দারাকুতনী (১১৮) বলেছেন, হাদীসটির সনদ সহীহ এবং বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য। নববীও এটাকে সহীহ বলেছেন (আল মাজমূ’ ৩/৩৩৩)
ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! রাতের নামাজ কীভাবে পড়তে হবে? নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘রাতের নামাজ ‘মাসনা’ ‘মাসনা’ । কিন্তু যখন রাত শেষ হয়ে যাওয়ার আশংকা করবে, তখন এক রাকাআত বিতর পড়ে নিবে’। (বুখারী ৯৯০, মুসলিম ৭৪৯)
‘মাসনা’ ‘মাসনা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে দুই রাকাআত দুই রাকাআত পড়বে। প্রত্যেক দুই রাকাআত পরে সালাম ফিরাবে। এক সঙ্গে চার রাকাআত পড়বে না।
প্রথম রাকাআতে সূরা আ’লা পড়বে। দ্বিতীয় রাকাআতে সূরা কাফিরূন পড়বে। আর তৃতীয় রাকআতে সূরা ইখলাস পড়বে।
দলীল:
উবাই বিন কা’ব রা. এর হাদীস। তিনি বলেন, ‘নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিতরের নামাজে সূরা আ’লা, সূরা কাফিরূন ও সূরা ইখলাস পাঠ করতেন (আবু দাঊদ ১৪২৩, নাসাঈ ১৭৩৩, ইবনে মাজাহ ১১৭১। নববী এটাকে বিশুদ্ধ বলেছেন ‘খুলাসা’- ১/৫৫৬, আলবানীও সহীহ বলেছেন- সহীহুন নাসাঈ ১/২৭৩)
‘কুনূত’ দ্বারা এখানে উদ্দেশ্য হলো দুআ করা। তৃতীয় রাকাআতে এটা পড়বে।
বিতরের নামাজে মাঝে মাঝে দুআ কুনূত পড়া সুন্নাত। কোনো কোনো সাহাবী এটা পড়েছেন বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। কখনও তারা ছেড়েও দিয়েছেন। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. এটাকেই পছন্দ করেছেন। সুতরাং উত্তম হলো পড়বে মাঝে মাঝে, ছাড়বে বেশি বেশি।
মাসআলা: বিতরের কুনূত পড়ার সময় হাত তুলবে কি না?
উত্তম: বিশুদ্ধ বক্তব্য মতে, দুআ কুনূত পড়ার সময় হাত তুলবে। এটাই সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামায়ে কিরামের বক্তব্য। ইবনে উমর রা. থেকে এটা প্রমাণিত। ইমাম বাইহাকী এটা বর্ণনা করেছেন এবং বিশুদ্ধ বলেছেন।
ইমাম বাইহাকী র. বলেন, ‘বেশ কয়েকজন সাহাবী দুআ কুনূতের সময় তাদের হাত তুলতেন’। (দেখুন: সুনানে কুবরা ২/২১১)
মাসআলা: বিতরের নামাজে কীভাবে কুনূত শুরু করবে?
বিশুদ্ধ বক্তব্য মতে- আল্লাহ ভালো জানেন-: প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা দিয়ে শুরু করবে। এরপর নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ওপর দরূদ পড়বে। এরপর দুআ করবে। এভাবে হলে কবুল হওয়ার আশা করা যায়।
দলীল:
ফাজালা ইবনে উবাইদ রা. এর হাদীস। তিনি বলেন, ‘প্রিয় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক ব্যক্তিকে নামাজে দুআ করতে শুনলেন। কিন্তু লোকটি তাঁর ওপর দুরূদ পড়লো না। তখন নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘সে বড্ড তাড়াহুড়া করে ফেললো। অতঃপর তিনি তাকে ডাকলেন এবং তাকে ও উপস্থিত সবাইকে বললেন, তোমাদের যখন কেউ দুআ করে তখন প্রথমে যেন আল্লাহর হামদ ও সানা পাঠ করে। এরপর নবীর ওপর দুরূদ পড়ে। এরপর যা ইচ্ছা দুআ করে’। (তিরমিযী ৩৪৭৭। ইমাম তিরমিযী বলেছেন, হাদীসটি হাসান সহীহ।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম র. বলেছেন, ‘দুআর ক্ষেত্রে মুস্তাহাব হলো নিজের প্রয়োজন তুলে ধরার আগে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করা। এরপর নিজের প্রয়োজন তুলে ধরা। যেমনটি পেছনে ফাজালার হাদীসের গেছে’। ( দেখুন- আল ওয়াবিলুস সাইয়্যিব পৃ. ১১০)
মাসআলা: দুআ কুনূতের পরে হাত মুখে মুছবে কি না?
বিশুদ্ধ বক্তব্য হচ্ছে দুআ কুনূতের পরে হাত মুখে মোছা সুন্নাত নয়। কারণ এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোনো দলীল নেই।
ইমাম মালেক র. এর কাছে এক ব্যক্তির ব্যাপারে বলা হলো যে সে দুআ কুনূতের পরে হাত মুখে মোছে। ইমাম মালেক র. এটাকে অপছন্দ করলেন এবং বললেন, ‘এমনটা আমি জানি না’। ( দেখুন- কিতাবুল বিতর- মারূযী পৃ. ২৩৬)
শাইখুল ইসলাম (ইবনে তাইমিয়া) র. বলেছেন, ‘দুআ কুনূতের পরে মুখে হাত মোছার ব্যাপারে এক দুইটা হাদীস পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলো দিয়ে দলীল দেয়া সম্ভব নয়। ( দেখুন ফাতওয়া ২২/৫১৯)
রাতের শেষ তৃতীয়াংশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত হচ্ছে দুআ করা। সুতরাং রাতের শেষ প্রহরে যদি কুনূতের ভেতরে দুআ করে তবে সেটাই যথেষ্ট। যদি কুনূতের ভেতরে দুআ না করে তবুও স্বাভাবিক দুআ করা উত্তম। কারণ এই সময়ে দুআ কবুলের বিশেষ সম্ভাবনা রয়েছে। এই সময়ে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন। বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরাইরা রা. থেকে সহীহ হাদীস এসেছে। প্রিয় নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আমাদের রব আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক রাতের যখন শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকে তখন দুনিয়ার আসমানে নেমে এসে ডাকতে থাকেন, ‘কে আছে যে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দিবো। কে আছে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে দিবো। কে আছে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো’। (বুখারী ১১৪৫, মুসলিম ৭৫৮)
দলীল:
উবাই বিন কা’ব রা. এর হাদীস তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিতরে সূরা আ’লা, সূরা কাফিরূন ও সূরা ইখলাস তিলাওয়াত করতেন। সালাম ফিরিয়ে তিনি তিনবার ‘সুবহানাল মালিকিল কুদ্দুস’ দুআটি পড়তেন। (নাসাঈ ১৭০২, নববী ও আলবানী এটাবে বিশুদ্ধ বলেছেন। আব্দুর রহমান ইবনে আবযী র. এর হাদীসে এসেছে, ‘তৃতীয়বারের সময় উচ্চস্বরে বলবে’। (আহমদ ১৫৩৫৪, নাসাঈ ১৭৩৪, আলবানী র. এটাকে বিশুদ্ধ বলেছেন। দেখুন তাহকীকু মিশকাতিল মাসাবীহ ১/৩৯৮)
|
তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য নিজের পরিবারকে জাগিয়ে দেয়া সুন্নাত। একইভাবে যদি স্ত্রীর আগে ঘুম ভাঙে, তবে সে নিজের স্বামী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জাগিয়ে দিবে। এটা ভালো কাজে পরস্পরের সহায়তার দৃষ্টান্ত। দলীল: আয়েশা রা. এর হাদীস। তিনি বলেন, ‘নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সারা রাত নামাজ পড়তেন। আমি তাঁর ও কিবলার মাঝে আড়াআড়ি হয়ে শুয়ে থাকতাম। পরে যখন তিনি বিতর শুরু করতেন, আমাকে ডেকে দিতেন, আমিও উঠে বিতর পড়তাম। (বুখারী ৫১২, মুসলিম ৫১২) |
উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার ( শেষ রাতে) ঘুম থেকে জেগে উঠে বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ। কত সম্পদ অবতীর্ণ হয়েছে। সুবহানাল্লাহ! কত ফিতনা ছড়িয়ে পড়েছে। গৃহ-বাসিনীদের (উদ্দেশ্য নিজের স্ত্রীগণ) কে ডেকে দিবে? যাতে তারা উঠে নামাজ পড়ে। দুনিয়ার অনেক বস্ত্রধারী পরকালে বস্ত্রহীন থাকবে’। (বুখারী ৬২১৮)
|
- সুতরাং যদি ক্লাসি এসে যায়, তবে বসে বসে নামাজ আদায় করবে। আনাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার মসজিদে প্রবশে করে দুইটি স্তম্ভের মাঝে টানটান করে একটা রশি বাঁধা দেখলেন । তিনি বললেন, এটা কী? সাহাবায়ে কিরাম বললেন, এটা যয়নব নামাজ পড়ার জন্য বেঁধেছে। যখন সে ক্লান্ত হয়ে যায় এটা ধরে ঝুলে থাকে। নবীজী দেখলেন বললেন, ‘এটা খুলে ফেলো। যতক্ষণ স্পৃহা ও উদ্যোম থাকে ততক্ষণ নামাজ পড়ো। যখন ক্লান্তি বা অসলতা এসে যায় তখন বসে পড়ো’। (বুখারী ১১৫০, মুসলিম ৭৮৪) - আর যদি ঘুমে ধরে তবে ঘুমিয়ে যাবে। পরে যখন শক্তি ফিরে আসবে, আবারও নামাজে দাঁড়াবে। আয়েশা রা. এর হাদীস এর দলীল। তিনি বলেন, নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমাদের কারও নামাজের ভেতরে তন্দ্রা এলে সে যেন শুয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয়। কারণ তন্দ্রালু হয়ে নামাজ পড়লে হয়তো ইস্তেগফার করতে গিয়ে কেউ নিজেকে গালি দিয়ে ফেলতে পারে’। (বুখারী ২১২, মুসলিম ৭৮৬)। - একইভাবে যদি রাতের বেলা কুরআন তিলাওয়াত অবস্থায় তন্দ্রা বা এজাতীয় কিছু পেয়ে বসে, তবে সুন্নাত হলো ঘুমিয়ে যাওয়া। যাতে করে শরীরে কর্ম-চঞ্চলতা ফিরে আসে। |
দলীল আবু হুরাইরা রা. এর হাদীস। নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি রাতে উঠে কুরআন তিলাওয়াত করে। কিন্তু তিলাওয়াত তার জন্য কঠিন হয়ে যায় এবং কী পড়ে নিজেও না জানে। তবে সে যেন শুয়ে পড়ে’। (মুসলিম ৭৮৭)
সুতরাং কারও যদি রাতে বিতরসহ তিন রাকাআত পড়ার অভ্যাস থাকে, কিন্তু সে নিদ্রা বা অসুস্থতা যে কোনো কারণে সেটা রাতে পড়তে না পারে, তবে দিনে চার রাকাআত পড়ে নিবে। আর যদি রাতে পাঁচ রাকাআত পড়ার অভ্যাস থাকে, তবে দিনে ছয় রাকাআত পড়ে নিবে। এভাবেই চলতে থাকবে। নবীজীও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমনটি করতেন। তিনি সাধারণত রাতের বেলা ১১ রাকাআত নামাজ পড়তেন। আয়েশা রা. বলেন, অসুস্থতা কিংবা নিদ্রাজনিত কারণে যদি রাতে নবীজী নামাজ পড়তে না পারতেন, তবে দিনের বেলা বারো রাকাআত নামাজ পড়ে নিতেন। (মুসলিম ৭৪৬)
